ঐতিহাসিক

সিলেট শহরের প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান সমুহ

September 28, 2021
শাহজালালের দরগাহ

সিলেট শহরে প্রচুর পরিমানে ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। সিলেটের জেলার ঐতিহাসিক স্থান সমুহ দেখার জন্য  দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসে।সবুজে মোড়ানো ছোট ছোট টিলার চা বাগানের দৃশ্য পর্যটকদের মুগ্ধকরে।শীত কালে অথিতি পাখীদের কলকাকলিতে হাওর এলাকা ভরে উঠে।প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলো শহরের আশপাশেই।

ক.হজরত শাহ জালাল(রঃ) এর মাজারঃ

হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। তিনি ছিলেন ওলিকুল শিরোমণি। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিন (র.) এর ওপর রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি অভিধায়ও অভিহিত করেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্নিক পুরম্নষ হযরত শাহজালাল (র.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইমেত্মকাল করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার।বাংলা ভাষায় লেখা সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে-হযরত শাহজালাল (র.) যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবরের চারপাশে ছোট্ট দেওয়াল তোলা হয়। পাশেই বানানো হয় একটি মসজিদ।

মাজারে কি কি দেখবেনঃ

১.দরগাহ মসজিদঃ

১৪০০ সালে বাংলার সুলতান আবু মুজাফর ইউসুফ শাহের  দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ সালে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের অন্যতম একটি মসজিদ।শাহজালালের দরগাহ

২.আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিলঃ

কথিত আছে, প্রাচ্যদেশে আসার পূর্বে শাহজালাল (র.) এর মামা মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর (র.) তাঁকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’ সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটির মিল পাওয়ায় হযরত শাহজালাল (র.) সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সিলেটে তেল ও গ্যাস পাওয়ায় আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল প্রমাণিত হয়েছে।

৩.গজার মাছঃ

হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। পুকুরে অজুর ব্যবস্থাও আছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগে পুকুরের প্রায় ৭শ’রও বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফলে পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (র.) এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফার (র.) মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ এনে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শ’তে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়।দরগাহ পুকুর

৪.জালালী কবুতরঃ

সিলেট ও আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা নাজিম উদ্দিন আউলিয়া(রঃ) প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ হজরত শাহজালাল(রঃ) কে দেওয়া এক জোড়া কবুতরের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর বধ করে না এবং খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজার কর্তৃপক্ষ এসব কবুতরের খাবার সরবরাহ করে থাকেন।জালালী কবুতর

৫.চিলস্নাখানাঃ

মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রীলঘেরা তারকাখচিত ছোট্ট যে ঘরটি রয়েছে, এটি হযরত শাহজালালের (র.) চিল্লা খানা। স্থানটি মাত্র দু’ফুট চওড়া। কথিত আছে যে, হযরত শাহজালাল (র.) এই চিলস্নাখানায় জীবনের ২৩ টি বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন।চিল্লাখানা

৬.জমজমের কূপ ও ঝরণাঃ

কথিত আছে যে হযরত শাহজালাল (র.) একটি কূপ খনন করার আদেশ দিয়ে প্রার্থনা করেন আল্লাহ্‌ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়।জমজম কোপ

৭.ডেকচিঃ

মাজারের পূর্ব দিকে দুতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরী করেন। যদিও ডেকচিগুলোতে রান্নাবান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরম্নর মাংস ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকাপয়সা দান করেন।ডেকচি

এ ছাড়াও দেখতে পাবেন হযরত শাহজালাল (র.) এর ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট এবং বাটি। দরগার দক্ষিণ দিকে দরগাহ মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর বাঁ দিকের বাড়িটি মুফতি নাজিমুদ্দিন আহমদের। এই বাড়িতে হযরত শাহজালালের (র.) তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে দরগাহ’র মোতওয়ালিস্নর বাড়িতে। এগুলো দেখতে প্রতিদিন উৎসুক মানুষের ভীড় জমে। হজরত শাহ জালাল(রঃ) এর মাজারের সম্মপুন্ন ভিডিও

যাতায়াতঃ

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টেশন থেকে দুরত্ব প্রায় ৩ কিঃমি। ভাড়া অটো রক্সায় ১৫০.০০-২০০.০০ টাকা।

গাজী বুরহান উদ্দীনের মাজারঃ

সিলেটের প্রথম মুসলমান গাজী বুরহান উদ্দীনের সমাধী।  শহরের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে সুরমা নদীর তীরে  অবস্থিত। সিলেট পৌরসভার আওতাধীন কুশিঘাট এলাকায় গাজী বুরহান উদ্দীনের ঐতিহাসিক বাড়িতেই তাঁর সমাধী বা মাজারের অবস্থান। শ্রীহট্ট (আধুনা সিলেট) অঞ্চলে বসবাসকারী খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দির প্রথম মুসলমান পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানটি সিলেটের অন্যতম পূণ্য তীর্থ হিসেবে পরিচিত।প্রাচীন শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের রাজা গৌড়-গোবিন্দের অত্যাচারে নিহত গাজী বুরহান উদ্দীনের ছোট শিশু গুলজারে আলমের মাজার বা সমাধি সহ এখানে আরো কয়েকটি মাজার পরিলক্ষিত হয়। উক্ত মাজার গুলোকে কেন্দ্র করে এখানে প্রতি দিন শত শত দেশ-বিদেশী দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।গাজী বুরহান উদ্দিন

হজরত শাহ পরানের মাজারঃ

শাহ পরা্ন (রহঃ) এর মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্য তীর্থ বা আধ্যাতিক স্থাপনা। যা হচ্ছে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য হতে বাংলাদেশে আসা ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমনী (রহঃ) এর অন্যতম সঙ্গী অনুসারী শাহ পরা্ন (রহঃ) এর সমাধি। এটি সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম নগর এলাকায় অবস্থিত। হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমনী (রহঃ) এর দরগাহ থেকে প্রায় ৮ কিঃমিঃ দুরত্বে শাহ পরাণের মাজার অবস্থিত। হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমনী (রহঃ) এর দরগাহর মতো এ মাজারেওপ্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ঐতিহাসিক মুমিনুল হক সহ অনেকেই লিখেছেন; সিলেট বিভাগ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শাহ পরা্ন (রহঃ) এর দ্বারা মুসলিম ধর্ম বিশ্বাষ ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার হয়েছে।শাহপরানের মাজার

সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমনগর এলাকায় টিলার উপর একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নীচে রয়েছে শাহ পরা্ন (রহঃ) এর মাজার। মাজার টিলায় উঠা নামার জন্য উক্ত মাজার প্রাঙ্গনে উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে সিঁড়ি আছে। যা প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু দেখায়। এই সিঁড়িটি মোগল আমলে নির্মিত বলে লোক মুখে শোনা যায়। মাজারের পশ্চিম দিকে মোগল বাদশাদের স্থাপত্বকীর্তিতে নির্মিত তিনটি গুম্বজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদে প্রায় ৫ শত মুসল্লী এক সাথে নামাজ আদায় করে থাকেন। মাজার টিলা থেকে প্রায় ১৫/২০ ফুট দহ্মিণ পশ্চিমে মহিলা পর্যটকদের জন্য এক ছালা বিশিষ্ট দালান ঘর রয়েছে। উক্ত দালানের অল্প পরিসর দহ্মিণ পুর্বে আরেকটি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এ ঘরখানা মুলত বিদেশাগত পর্যটকদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ঘরের পাশেই একটি পুকুর রয়েছে, যা অজু গোসলের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে।

যাতায়াতঃ

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টেশন থেকে দুরত্ব প্রায় ৯.৬ কিঃমি। ভাড়া অটো রক্সায় ৩০০.০০-৩৫০.০০ টাকা।

শাহী ঈদগাহঃ

সিলেটের শাহী ঈদগাহ দেশের প্রাচীনতম ঈদগাহ। মনোমুগ্ধকর কারুকার্যময় এই ঈদগাহটি মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নির্মাণ করেন। এখানে এক সাথে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লী ঈদের জামাত আদায় করতে পারেন। ঈদগাহর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় এর অবস্থান। তাই ঈদগাহটির এমন নামকরণ হয়েছে। ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন কর্মকর্তার বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালাল(র:) এর অন্যতম সফরসঙ্গী শাহ মিরারজী (র:) এর মাজারের পাশের টিলার ওপর রয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।শাহী ঈদগাহ

অনুপম কারুকার্যখচিত এই ঈদগাহের মূল ভূ-খন্ডে ২২টি সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতে হয়। এরপরই ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত ঈদগাহ। সীমানা প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে-ছোট বড় ১০টি গেইট। ঈদগাহের সামনে অজুর জন্য বিশাল পুকুর অবস্থিত।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে এখানে সৈয়দ মোহাম্মদ হাদী ও সৈয়দ মোহাম্মদ মেহেদী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। ইংরেজদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শহীদ হন।

প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উপলক্ষে এখানে বিশাল দুটি ঈদ জামাত অনুষ্টিত হয়। এখানে এক সাথে লক্ষাধিক মুসল্লি ঈদ জামাত আদায় করতে পারেন।

স্থানটি নানা কারণে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। এখানেই হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থান হয়েছে। ভারতের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্না গান্ধী থেকে শুরু করে কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো নেতাদের পাদস্পর্শে ধন্য স্থানটি। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থানও ছিল এটি।

যাতায়াতঃ সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টেশন থেকে দুরত্ব প্রায় ৩.৯ কিঃমি। ভাড়া অটো রক্সায় ১৫০.০০-২০০.০০ টাকা।

You Might Also Like

2 Comments

  • Reply সিলেটের ঐতিহাসিক স্থান সমুহ - Tour Sylhet Bd September 28, 2021 at 7:25 am

    […] সিলেটের আরও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান সমুহ […]

  • Reply সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান সমুহ - Tour Sylhet Bd September 28, 2021 at 2:25 pm

    […] দেখতে পারেন সিলেটের ঐতিহাসিক স্থান […]

  • Leave a Reply